• রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

  • || ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আজকের সাতক্ষীরা

মুসলিম ঐতিহ্য : গ্রিসে মাদরাসা শিক্ষার স্মৃতি

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ৯ জুলাই ২০২৪  

এজিয়ান সাগরের তীরে উত্তর গ্রিসের একটি নির্জন উপদ্বীপ কাভালা। কাভালা সমুদ্রবন্দর থেকে দক্ষিণের থাসোস দ্বীপের বনভূমির পথেই পলিডো স্ট্রিট, যে এলাকাকে পুরনো মুসলিম কোয়ার্টার বলা হয়। এখানেই দাঁড়িয়ে আছে দুই শ বছরের প্রাচীন প্রাসাদ ইমারেত। প্রাসাদের গম্বুজযুক্ত সিসার ছাদ, সারি সারি স্তম্ভ ও বাগান বেষ্টিত নির্জন জলাধার অতীত গৌরবের কথা মনে করিয়ে দেয়।

 

উসমানীয় গভর্নর মুহাম্মদ আলী পাশা প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। পরে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। বলা হয়, তিনি আধুনিক মিসরের স্থপতি এবং স্বল্পকালীন একটি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর বাহিনী একসময় সৌদি আরব থেকে গ্রিসের পেলোপনিস পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিল।

 

কাভালায় নির্মিত ভবনটি বারোক অটোমান কমপ্লেক্স নামে পরিচিত। তুর্কি ভাষায় একে ইমারেত বলা হয়। কমপ্লেক্সে একসময় দুটি মাদরাসা, ছাত্রাবাস, কোরআনিক মক্তব, গোসলখানা, প্রার্থনাকক্ষ (মসজিদ) ও লঙ্গরখানা ছিল। তিনটি উঠান ঘিরে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়।

 

বর্তমানে ভবনটি হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাচীন এই মাদরাসা ভবনটি মিসরীয় সরকারের মালিকানাধীন ওয়াকফ সম্পত্তি। মুহাম্মদ আলী পাশার বংশধরের দ্বারা পরিচালিত একটি ধর্মীয় ট্রাস্টের অধীনে তা পরিচালিত হয়।

প্রাচীন এই মাদরাসা ভবনের নির্মাণশৈলীতে উসমানীয় ঐশ্বর্য এবং সমকালীন বলকানীয় চরিত্রের মিশ্রণ রয়েছে। ছাত্রাবাসের চিমনিগুলো হোটেলকক্ষে প্রবেশ করেছে।

 

ইমারেতের বিশেষ সিসার ছাদে রয়েছে এক ডজনেরও বেশি অনুচ্চ গম্বুজ। দীর্ঘ জলাধারটি বন্ধনী দেয়াল, মনোরম বারান্দা ও কমলাগাছে ঘেরা, যার এক প্রান্তে আছে মার্বেল পাথরের তৈরি ঘাট। কমপ্লেক্সের নির্জন এই অংশে এলে চোখ বুজলেই যেন কল্পনা করা যায়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সাদা পোশাক পরে জলাধারের চারপাশে ঘোরাফেরা করছে।

মুহাম্মদ আলী পাশা ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে কাভালায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার মধ্য আনাতোলিয়ার কোনিয়া থেকে এখানে এসেছিল। তিনি প্রথমে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে জীবন শুরু করেন। কিন্তু মিসর থেকে নেপোলিয়নের বাহিনীকে বিতাড়ন করতে সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ পরিচালিত অভিযানে অংশ নেন। বিচক্ষণতা, সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে তিনি উসমানীয় সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে পাশালিকের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। মুহাম্মদ আলী কায়রো দুর্গে মামলুকদের কঠোর হস্তে দমন করেন। ক্ষমতা লাভের পর তিনি মিসরে পশ্চিমা ধাঁচে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেন, যার মধ্য দিয়ে আধুনিক মিসরের ভিত্তি গড়ে ওঠে।

ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেও মুহাম্মদ আলী কখনো জন্মস্থান কাভালা ভুলে যাননি। তিনি সেখানে গড়ে তোলেন সমৃদ্ধ মাদরাসা। মাদরাসার প্রথমাংশ নির্মিত হয়েছিল ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে। তখন মাদরাসা ভবনে একটি পাঠাগার, একটি মক্তব, একটি সভাকক্ষ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ৬০টি ছোট কক্ষ ছিল। মুহাম্মদ আলী পাশার ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাদরাসার আয়তনও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সৌদি আরবে ওয়াহাবি আন্দোলন দমনের পুরস্কারস্বরূপ সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ তাঁকে থাসোস দ্বীপের মালিকানা ও রাজস্বের অধিকার দান করেন। ১৮১৩ সালে সুলতান থাসোস দানের ফরমান জারি করেন। মুহাম্মদ আলী পাশা দ্বীপের আয় তাঁর জন্মভূমির কল্যাণে ব্যয় করেন। ১৮২০ সালে ইমারেতের দ্বিতীয় প্রাঙ্গণে একটি প্রকৌশল বিদ্যালয় ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮২১ সালে তৃতীয় প্রাঙ্গণে লঙ্গরখানা তৈরি করা হয়। মূলত কাভালার এই মাদরাসার মাধ্যমে মুহাম্মদ আলী জন্মস্থানে তাঁর স্মারক রেখে গেছেন।

১৮২০ সালে গ্রিকরা উসমানীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে সুলতান মুহাম্মদ আলী পাশাকে তা কঠোরভাবে দমনের নির্দেশ দেন। মুহাম্মদ আলীর ছেলে ইবরাহিম পাশা ১৮২২ সালে প্রথমে ক্রিটে এবং দুই বছর পর মূল ভূখণ্ডে কঠোরভাবে গ্রিক বিদ্রোহ দমন করেন। কিন্তু মুহাম্মদ বুঝতে পেরেছিলেন, গ্রিসে উসমানীয়দের শাসনকাল শেষ হয়ে আসছে। তিনি সুলতানকে গ্রিক ও তার ইউরোপীয় সহযোগীদের সঙ্গে আপস মীমাংসার পরামর্শ দেন। কিন্তু সুলতান তা উপেক্ষা করেন। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে নাভারিনোর যুদ্ধে ব্রিটিশ, ফরাসি ও রুশ সম্মিলিত বাহিনী ইবরাহিম পাশার নৌবহর ধ্বংস করে ফেলে। এর পর থেকে মুহাম্মদ আলী উসমানীয় সুলতানের পরিবর্তে ইউরোপীয়দের প্রতি ঝুঁকে যান। ইউরোপীয়দের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেন। পুরস্কারস্বরূপ ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তাঁর পরিবার মিসর শাসন করে। ১৯১২ সালে গ্রিকরা কাভালা দখল করার আগ পর্যন্ত ইমারেতে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা ও তার ধর্মীয় কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। লঙ্গরখানাটি চালু ছিল ১৯২৩ সাল পর্যন্ত।

১৯২৩ সালে লুজিয়ান চুক্তির মাধ্যমে যখন গ্রিস-তুরস্ক যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং বিপুলসংখ্যক খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী তুরস্ক ছেড়ে গ্রিসে চলে যায়, তখন খ্রিস্টান শরণার্থীরা ইমারেতে আশ্রয় নেয়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ইমারেতে শরণার্থীদের অবস্থান বজায় ছিল। এরপর দীর্ঘদিন এটি পরিত্যক্ত ছিল। অতঃপর কাভালার একজন ধনী নারী মিসর সরকারের কাছ থেকে এটি ৫০ বছরের জন্য লিজ নেন এবং দুই বছরের সংস্কারকাজের পর ২০০৪ সালে অভিজাত হোটেল প্রতিষ্ঠা করেন। কাভালা গ্রিসের কোনো জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র নয়, তবে কাভালার ঐতিহাসিক মাদরাসাটি মুসলিম পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। তারা সেখানে অতীত ঐতিহ্য ও হারানো গৌরবের স্বাদ     অনুভব করে।