• রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

  • || ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আজকের সাতক্ষীরা

কুরবানি করা এবং মাংস খাওয়ায় যেসব স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরি

আজকের সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৫ জুন ২০২৪  

কুরবানির ঈদ মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব, যা ধ্বনিত হয় আত্মত্যাগ ও দানের মহিমায়। এ বিশেষ দিনটি মুসলমানরা পশু কুরবানির মাধ্যমে পালন করে থাকেন, যা ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সম্পন্ন হয়। তবে এ ধর্মীয় আচার পালনের সময় স্বাাস্থ্য বিষয়ে বিশেষ যত্ন নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে এ সময় ‘রেড মিট’ বা ‘লাল মাংস’ বেশি খাওয়া হয়। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থেকে কীভাবে নিজেকে সুস্থ রাখবেন সে বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ ডা. তাহমীদ কামাল

কুরবানির জন্য সঠিক পশু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রোগমুক্ত, সুস্থ ও সবল পশু নির্বাচন করতে হবে। পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে, এ পশু কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত নয়। ফলে কুরবানির পশু থেকে মানুষের মধ্যে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়।

* পশু সংক্রমণ ও পরিচর্যা

কুরবানির আগে পশুর পরিচর্যা করা জরুরি। পশুর খাদ্য, পানীয় এবং আশ্রয়ের দিকে যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া পশুর শরীরে যদি কোনো ক্ষত বা ফোসকা দেখা যায়, তবে দ্রুত পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

* কুরবানির স্থান নির্বাচন

কুরবানি করার জন্য পরিষ্কার ও সঠিক স্থান নির্বাচন করা উচিত। যেখানে কুরবানি করা হবে সে স্থানটি জীবাণুমুক্ত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কুরবানি করার স্থানটি যেন পরিষ্কার ও সংক্রমণমুক্ত থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

* স্বাস্থ্যকর কুরবানি পদ্ধতি

কুরবানির সময় স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি অবলম্বন করা জরুরি। কুরবানি করার সরঞ্জামগুলো পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত হওয়া উচিত। কুরবানি করতে ব্যবহৃত ছুরি বা অন্যান্য ধারালো যন্ত্রগুলো ব্যবহারের আগে ও পরে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা উচিত।

* বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

কুরবানির পর পশুর বর্জ্য ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। খোলা স্থানে বর্জ্য ফেলে দেওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং এটি রোগ-জীবাণু ছড়াতে পারে। বর্জ্য অপসারণের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশিকা মেনে চলা উচিত।

* মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ

কুরবানির পর মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মাংস কাটা, পরিষ্কার করা এবং সংরক্ষণ করার সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা আবশ্যক। মাংস সংরক্ষণের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত উপায় অবলম্বন করা উচিত, যাতে এটি দূষণমুক্ত থাকে এবং দীর্ঘদিন ভালো থাকে।

গরুর মাংস পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি খাবার, যা সঠিক পরিমাণে ও স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে রান্না করে খেলে শরীরের বিভিন্ন উপকার হতে পারে। তবে অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত পরিমাণে গরুর মাংস খেলে কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকিও থাকতে পারে। গরুর মাংসের স্বাস্থ্যগুণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-

* গরুর মাংসের স্বাস্থ্যগুণ

▶ উচ্চ প্রোটিন : গরুর মাংসে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে, যা শরীরের পেশি গঠন ও মেরামতে সহায়ক।

▶ ভিটামিন ও খনিজ : গরুর মাংসে প্রচুর ভিটামিন বি১২, জিঙ্ক, আয়রন এবং সেলেনিয়াম থাকে, যা রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরি এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

▶ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড : ঘাস খাওয়ানো গরুর মাংসে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকে, যা হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

▶ কনজুগেটেড লিনোলিক অ্যাসিড (CLA) : গরুর মাংসে CLA পাওয়া যায়, যা ক্যানসার প্রতিরোধ এবং ফ্যাট বিপাকে সহায়ক।

▶ ক্রিয়েটিন : গরুর মাংসে ক্রিয়েটিন থাকে, যা মাংসপেশির শক্তি বাড়াতে সহায়ক এবং শরীরের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

▶ গ্লুটাথিওন : গরুর মাংসে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে গ্লুটাথিওন থাকে, যা শরীরের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।

* গরুর মাংসের স্বাস্থ্যঝুঁকি

▶ হৃদরোগের ঝুঁকি : গরুর মাংসে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকে, যা অতিরিক্ত খেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

▶ ক্যানসারের ঝুঁকি : অতিরিক্ত লাল মাংস বা প্রক্রিয়াজাত মাংস খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে, বিশেষত কোলন ক্যানসার।

▶ উচ্চরক্তচাপ : গরুর মাংসের স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কোলেস্টেরল উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

▶ ওজন বৃদ্ধি : অতিরিক্ত পরিমাণে গরুর মাংস খেলে ওজন বৃদ্ধি হতে পারে, যা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে।

▶ পিউরিন : গরুর মাংসে পিউরিন থাকে, যা গাউট বা ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি করতে পারে।

* স্বাস্থ্যকর উপায়ে গরুর মাংস খাওয়ার টিপস

▶ পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ : প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট পরিমাণে গরুর মাংস খাওয়া উচিত, যেন অতিরিক্ত স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কোলেস্টেরল গ্রহণ করা না হয়।

▶ রান্নার পদ্ধতি : মাংস গ্রিল, বেক বা সিদ্ধ করে খাওয়া উত্তম। ভাজার পরিবর্তে এসব পদ্ধতিতে রান্না করলে স্বাস্থ্যকর হয়।

▶ চর্বি অপসারণ : রান্নার আগে মাংস থেকে অতিরিক্ত চর্বি অপসারণ করা উচিত।

▶ প্রক্রিয়াজাত মাংস এড়িয়ে চলা : প্রক্রিয়াজাত মাংস যেমন সসেজ, বেকন এড়িয়ে চলা ভালো।

▶ সুষম খাদ্য : গরুর মাংসের পাশাপাশি পর্যাপ্ত শাকসবজি, ফলমূল, এবং স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করা উচিত, যেন খাদ্যাভ্যাস সুষম হয়।

সঠিকভাবে ও নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে গরুর মাংস খেলে শরীরের পুষ্টির চাহিদা মেটানো যায় এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

* মাংস বিতরণ ও খাওয়ার স্বাস্থ্যবিধি

কুরবানির মাংস বিতরণের সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত। মাংস বিতরণের আগে এবং পরে হাত ভালোভাবে ধুতে হবে। মাংস রান্নার সময় পর্যাপ্ত তাপমাত্রায় রান্না করা উচিত, যাতে মাংসে কোনো জীবাণু অবশিষ্ট না থাকে।

* ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সচেতনতা

কুরবানির সময় ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরি। যারা কুরবানি কাজে সরাসরি অংশ নেন তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী যেমন গ্লাভস, মাস্ক এবং অ্যাপ্রোন পরা উচিত। এছাড়া কাজ শেষে ভালোভাবে হাত ও মুখ ধুতে হবে।

* সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্ব

কুরবানির ঈদ উদযাপনের সময় সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্ব পালন করা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ দূষণ রোধে এবং সমাজের সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত। এতে সমাজে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ বজায় থাকে।

কুরবানির ঈদ একটি পবিত্র ধর্মীয় আচার, তবে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে এটি আরও নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকরভাবে পালন করা যায়। এ সচেতনতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।